ঠাম্মা আর মাছ চোরের গল্প

ঠাম্মা আর মাছচোরের গল্প
-দীপালী পাল
(সত‍্য ঘটনা)

 

আমি যখন আমার ঠাম্মাকে দেখেছি তখন তাঁর বয়স প্রায় আশির কাছাকাছি। আজ তিনি বেঁচে নেই কিন্তু আজও ঠাম্মার কথা মনে পড়লে তাঁর একটা গল্প আমাদের প্রায়শঃই মনে পড়ে।
দেখতে খুব সুন্দরী ছিল আমার ঠাম্মা,গায়ের রঙ ছিল খুব ফর্সা,মাথা ভর্তি কাঁচা পাকা চুল ছিল,কপালে সবসময় সিদুঁরের বড় টিপ পরতেন আর সিথিঁ ভরাতেন সিঁদুর দিয়ে। সবসময় পান তার মুখে ভরা থাকতো,লাল লাল ঠোঁটে যখন মিষ্টি মিষ্টি কথা বলতেন তখন অতি বড় শত্রু ও তাকে ভালোবেসে ফেলতো। কাউকে যত্ন করায় তার কোনো অলসতা ছিলনা।
সেই সময় বাংলাদেশে খুলনাতে বনেদী পরিবার হিসেবে আমার ঠাকুর্দার বাড়িটি বেশ সুখ‍্যাত ছিল।
আমার বাবারা ছিলেন ছয় ভাই। বাবা ও সেজ জ‍্যাঠার পরিবারকে নিয়ে ঠাকুর্দা ঠাকুমা ঐ বাড়িতে থাকতেন।আমার মা এর তখন নতুন বিয়ে হয়েছে।
দুই বিঘা জমির মধ্যে চারিদিকে গাছপালায় ঘেরা ছিল ,বাড়িটি ছিল দোতলা ,আর বাড়ি থেকে কিছুটা দূরে দুটো পুকুর ছিল,সেই পুকুরে প্রচুর মাছ ছাড়তেন আমার ঠাকুর্দা,দুটো পুকুরের মাছেই বাড়ির প্রতিদিনকার মাছ খাওয়ার কাজ হয়ে যেত,বাজার থেকে মাছ প্রায় কেনা হতনা বললেই চলে।
একবার ঠাকুর্দা পাড়ার কয়েকজন লোকের কাছ থেকে জানতে পারলেন কারা যেন পুকুরে মাছ চুরি করতে আসে,সেই কারণেই ঠাকুর্দা পাড়ার দু’জন লোক আর আমার বাবা ,জ‍্যাঠাকে নিয়ে ‘মাছ চোর’ধরার জন্য সারা রাত পুকুরের পাশে আম বাগানে লুকিয়ে বসে থাকলেন,অনেক রাতে চারজন চোর এলো,যেই কিনা পুকুরে জাল ফেলতে যাবে আমার ঠাকুর্দা তার দলবল কে নিয়ে চোরেদের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ল,তিন জন চোর ই দৌড়ে পালিয়ে গেল,কিন্তু একজন যার হাতে জাল ছিল তার পা গেল পুকুরের কাদামাটির মধ্যে আটকে,ব‍্যস সে ধরা পড়ে গেল।বছর পচিঁশের কালো ছিপছিপে দেখতে একটা ছেলে,সবাই কিল, চড় ,ঘুষি মেরে তাকে কাবু করে ফেলল,তারপ‍র তাকে আটকে রাখা হল একতলার একটা ফাঁকা ঘরে।
ঠাকুমা সকাল বেলা নীচের ঘরে চোরটিকে দেখতে এলেন,জিজ্ঞেস করলেন–‘তুমি চুরি করো কেন গো বাছা,কতো মার খেলে,তোমার বাবা মা তোমায় শাসন করেনা বোধহয়,বুঝবে মজা,এখন সবাই মিলে তোমাকে থানায় নিয়ে পুলিশের হাতে তুলে দেবে’
পুলিশের কথা শুনতেই চোরটি ঠাকুমার পা জড়িয়ে ধরে বলল—“মা ঠাকরুন,পায়ে পড়ি আপনার ,আপনারা আমারে পুলিশির হাতে তুলে দ‍্যান না,পুলিশ আমারে খুব মারবে,আমি সহ্য করতি পারবোনা,,তারপর আবার জেলে দিলে আমার অবস্তা এক্কেবারে খ্যারাপ হৈয়ে যাবে,ভুল হৈয়ে গেছে ক্ষমা কৈরে দ্যান”
চোরটা র জন‍্য ঠাকুমার মনে একটু দয়া হল,বললেন,,’দাঁড়াও কর্তাকে বলে দেখি,’
তারপর ঠাম্মার কথা মতো চোরটিকে থানায় নিয়ে যাওয়া‌ হয়নি,কিন্তু তাকে সারাদিন ঐঘরে আটকে রাখা হল,
ঠাকুমা মা আর জেঠিকে বললেন—-‘চোরটা সারাদিন কিছু খায়নি,বেচারা একটু নয় অপরাধ করেই ফেলেছে ওকে এক‌টু খেতে দিলে কেমন হয়?’
ঠাকুমার কথা শুনে মা আর জেঠি বলল—“একটা চোরের উপর আপনার এ্যতো মায়া হচ্ছে!!”
ঠাকুমা করুণ মুখ করে বললেন”ও তো আমার ছেলের বয়েসি ও তো কোনো মায়ের ছেলে,বাচ্চা ছেলে কেমন করে আমার পা দুখানা জড়িয়ে ধরল বলো’
মা আর জেঠিমা একে অপরের দিকে চোখ চাওয়া চাওয়ি করলো কেউ কোনো কথা বললো না,এরপর ঠাকুমা ডাল তরকারী ,রুই মাছ ঝোল সমেত চোরটিকে পেট পুরে খাওয়ালো,তা ও আবার লুকিয়ে লুকিয়ে,পাছে কেউ জানতে পেরে ঠাকুর্দাকে বলে দেয় সেই ভয়ে,,,,
চোর ব‍্যাটাও তেমনি,সেও পালাবার চেষ্টা না করে পেট পুরে খাবার খেলো,তারপর ঠাকুমার পায়ে একটা প্রণাম ঠুকে বলল,,,মা আপনি বড্ড ভালো মানুষ,আপনার মতো মানুষ আমি এই পেথ্যম দ‍্যখলাম”
বলেই চোরটি ঠাকুমার পা জড়িয়ে কাঁদতে কাঁদতে বলল-“আপনারে আমি কথা দিচ্ছি আমি আর কোনোদিন ও চুরি করবো না ”
তার কিছুক্ষণ পরেই ঠাকুর্দা এসে মাছচোরকে ছেড়ে দেয়,তিনি কোনদিন ও জানতে পারেন নি এসব কথা,
কিন্ত এই ঘটনার পর থেকে পুকুরের মাছ কোনোদিন ও আর চুরি হয়নি,
ঠাম্মা হয়তো আজ নেই বছর কুড়ি কিন্তু তার চোরকে যত্ন করার গল্পটা আজ ও আমার মা স্মৃতিচারণ করে ।।

Loading

Leave A Comment